গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা কাকে বলে? গর্ভাবস্থায় পরিচর্যার উদ্দেশ্য

গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা কাকে বলে?

নিয়মানুযায়ী গর্ভবতী নারীকে পরীক্ষা করা ও বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ দেওয়াকে গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা বলে। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য এটি একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে গর্ভজনিত কারণে মায়ের মৃত্যুহার উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দু-তিনশ গুণ বেশি।

গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা কাকে বলে? গর্ভাবস্থায় পরিচর্যার উদ্দেশ্য

গর্ভাবস্থায় পরিচর্যার উদ্দেশ্য

১) গর্ভজনিত কারণে মা ও শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা।
২) নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি করা।
৩) গর্ভের জন্য কিছু রোগ বা জটিল সমস্যা নির্ণয়, প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা।
৪) নিজের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখার জন্য মানসিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা।
৫) গর্ভবতী নারীকে খাদ্য-পুষ্টি, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি ও শিশুর যত্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করা।

চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ

অন্তঃসত্তা অবস্থার শুরুতেই চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করানো ও তাঁর উপদেশ নেয়া উচিত। প্রথম পরীক্ষার পর ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে একবার, ২৯-৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে দুবার ও ৩৭ সপ্তাহ থেকে প্রসব না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে একবার পরীক্ষা করানো উচিত। এ ছাড়াও কখনো কোনো সমস্যা দেখা দিলে নির্ধারিত দিনের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রথম পরীক্ষার সময় রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করিয়ে নিতে হয়। রক্তের গ্রুপ, যৌনরোগ, রক্ত শর্করা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয় তাতে আমিষ বা শর্করা আছে কিনা জানার জন্য। পরবর্তী পরীক্ষায় ভ্রূণের বৃদ্ধি, মায়ের ওজন বৃদ্ধি (যা ১২ – ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত লাগাতার হয়), রক্তাচাপ, গা-হাত-পা ফুলে উঠা, ভ্রূণের অবস্থান প্রভৃতি নানা বিষয়ের পরীক্ষা করা হয় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। 

গর্ভাবস্থায় ছোট-খাট সমস্যাগুলো হচ্ছে বমিভাব বা বমিকরা, কোমর ব্যথা, পা ব্যথা বা পায়ে খিল ধরা, বুক জ্বলা, অর্শের সমস্যা ও সাদা স্রাব। এসব কষ্ট লাঘবের জন্য উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়।

গর্ভাবস্থায় পালনীয় বিষয়

গর্ভবর্তী মায়ের পুষ্টির উপরই নির্ভর করে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ জীবনে ভালো থাকা। তাই সুষম সহজপাচ্য ও সঠিক পরিমাণ আহার প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় সুষম আহার বলতে বোঝায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বেশি পরিমাণ প্রোটিন, সঠিক পরিমাণ শর্করা ও কম পরিমাণ চর্বি জাতীয় খাদ্যের সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণ লৌহ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও অন্যান্য পদার্থ, যথা- জিঙ্ক, ফলিক এসিড, পটাসিয়াম, সেলেনিয়াম প্রভৃতি। মায়ের খাদ্য থেকে যে পরিমাণ লৌহ আসে তাতে গর্ভকালীন লৌহের প্রয়োজন মেটে না, তাই প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রাম ফেরাস সালফেট বড়ি সেবন করতে হয়।

একজন ৫০ কেজি ওজনের গর্ভবতী নারীর দৈনিক ২৫০০ ক্যালরি দরকার। সম্ভব হলে দিনে ১ লিটার দুধ, ১ বা ২ টুকরা মাছ বা মাংস, ১টি ডিম, ১টি বা ২টি ঋতুকালীন ফল, টাটকা শাকসবজি এবং ভাত ও ডাল পেট ভরে খাওয়া উচিত। নিরামিষভোজীদের দুধের পরিমাণ বাড়াতে হয়। তা ছাড়া অঙ্কুরিত ছোলাও খাদ্য তালিকায় যোগ করা উচিত। প্রতিদিন ৬ -৮ গ্লাস ফোটানো পানি খাওয়া প্রয়োজন। পাতে বাড়তি লবণ, রাস্তাঘাটের অপরিস্কার খাবার, টক-ঝাল-মশলাদার খাবার, ভাজা, চাটনি ইত্যাদি খাওয়া গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে চলা উচিৎ।

গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা থাকে। এর সমাধানকল্পে বেশি পরিমাণ শাকসবজি খাওয়া দরকার। তা ছাড়া শুকনো খেজুর ও বীট খাবার তালিকায় রাখা উচিত। গর্ভাবস্থায় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। তাই এ সময় দাঁত না তোলাই ভালো। স্তনবৃন্ত স্তনের মধ্যে থাকলে তা উপরে উঠানোর চেষ্টা করতে হবে যাতে প্রসবের পর শিশুকে স্তন্যদানে কোনো সমস্যা না হয়। এ জন্য কোনো ক্রিম ব্যবহার করা উচিত। তা না হলে দুধ জমে গিয়ে স্তনেও নানা কষ্টের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।

গর্ভাবস্থায় পরিমিত বিশ্রাম দরকার। দুপুরে দু’ঘণ্টা, রাতে আট ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া উচিত। সব সময় বাঁ পাশে কাত হয়ে শোয়া উচিত। এতে শিশুর বিকাশ স্বাভাবিক হয়। স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা নেই, তবে ভারী কাজকর্ম করা একেবারেই উচিত নয়। গর্ভাবস্থায় তলপেটের চামড়ায় টান পড়ার জন্য যোজক টিস্যুর তন্তুগুলো ছিঁড়ে যায়, ফলে তলপেটে সাদা দাগ পড়ে। এ অবস্থা এড়াতে হলে গর্ভাবস্থায় প্রথম মাস থেকে প্রসবের পরেও কয়েক মাস বুকে ও পেটে রোজ তেল মালিশ করতে হবে। 

রোজ গোসল করে শরীর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গোসল করার সময় যেন পিছলে পড়ে না যায় সেদিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভাবস্থায় ঢিলেঢালা কাপড় পড়া উচিত। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সুতীর কাপড় – চোপড় পড়া স্বাস্থ্যসম্মত। ঝাকুঁনিযুক্ত ক্লান্তিকর ভ্রমণ গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস ও শেষ দুমাস না করাই ভালো। বাসের চেয়ে রেল ও বিমানে ভ্রমণ-ঝুঁকি অনেক কম। 

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ধুমপান ও মদ্যপান অনুচিত। তা না হলে কম ওজনের শিশু কিংবা বিকলাঙ্ক শিশুর জন্ম হতে পারে। গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে প্রথম তিন মাস অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং নিরাপদ সুনিশ্চিত জেনে তবেই ওষুধ সেবন করা উচিত। কারণ অনেক ওষুধ গর্ভস্থ শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।

গর্ভের প্রথম তিন মাস ও শেষ দেড় মাস যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা উচিত। এতে গর্ভপাত, অকাল প্রসব ও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। গর্ভাবস্থার পঞ্চম ও ষষ্ঠ মাসে টিটেনাস টক্সাইডের একটি করে মাত্রা নেওয়া উচিত। এতে শুধু মা-ই নয় নবজাত শিশু দেড় মাস বয়স পর্যন্ত ভয়ংকার ধনুষ্টংকার (টিটেনাস) রোগ থেকে রক্ষা পায়।

আরো পড়ুনঃ

Leave a Comment